দেখতে দেখতে সাড়ে চার বছরের অনার্স লাইফ শেষ হতে চলেছে।প্রথমদিকে যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হই- আমি জায়গাটিকে বেশ বেমানান এবং রঙচটাহীন হিসেবে কল্পনা করতে আরম্ভ করি।কিন্তু যতই সময় যেতে থাকে,আমার কল্পনার বিভ্রমের জটও ততই খুলতে থাকে।আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হই- না, এই জায়গাটি আমার জন্যই অথবা এই জায়গাটির জন্যই আমি! প্রথমদিকে ভেবেছিলাম - সেকেন্ড টাইম ট্রাই করে দেখি।অন্য কোথাও যদি হিল্লে হয়- তবে কি দরকার এই অঁজপাড়াগায়ে থাকার? ব্লা ব্লা ব্লা! আমি সম্ভবত ভুলতেই বসেছিলাম- আমি যেটাকে অঁজপাড়াগা ভাবছি, সে অঁজপাড়াগাকে আমাদের জাতীয় কবি,চির-বিপ্লব,বিদ্রোহ এবং মানবতার কবি 'কাজী নজরুল ইসলাম' এক ধরণের স্বর্গরূপ হিসেবে দেখেছেন। আমাদের প্রাণের কবি যেটাকে স্বর্গরূপ হিসেবে দেখেছেন,সেটাকে আমি কিভাবে নরকরূপে দেখি? একথা ভাবতে ভাবতেই নিজের ভেতরে এক ধরণের অনুতাপবোধ কাজ করতে আরম্ভ করলো।যাই হউক, লক্ষ্য স্থির করলাম।যেভাবেই হউক, আবিষ্কার করবোই- কবি নজরুল কেন এ জায়গাটিকেই স্বর্গরূপ হিসেবে কল্পনা করেছিলেন? কবি নজরুলকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করতে করতে কখন যে নিজেকেই আবিষ্কার করে ফেললাম, সে কথা আরেকদিন বলবো।তবে এতটুকু বলি- ত্রিশালে না আসলে যে আমার জীবনটা ষোল আনাই বৃথা থেকে যেতো,এতটুকু নিশ্চিত!
এবার আসি আমার বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে।ঐ যে প্রথমেই বললাম- ত্রিশাল নিয়ে আমার যেমন বিভ্রম ছিলো, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও তার খানিকটা কম ছিলো না! নতুন বিশ্ববিদ্যালয়,নতুন জায়গা,এই নেই-সেই নেই। আরো কত কিছু! কিন্তু এ কথা ভুলতেই বসেছিলাম- আরে সময় দাও,হচ্ছে তো,হবে তো; সবকিছুই হবে।তার মধ্যেই একটি চিন্তা মাথায় ধরলো- আরে আমি এমন একটা প্রতিষ্ঠানে পড়ছি, যে প্রতিষ্ঠানটি সৃষ্টি হয়েছে একজন মহান ব্যক্তির স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে মনেপ্রাণে লালন করার জন্য।তিনিই আমাদের- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি- কাজী নজরুল ইসলাম এমন একজন ব্যক্তি যার একজন নিন্দুকও বাংলাদেশ কিংবা গোটা ভারতবর্ষে খুঁজে পাওয়া যাবে না।নজরুলকে ভালোবাসে না কিংবা নজরুলের সাহিত্যকর্ম পড়ে উজ্জীবিত হয় নি,এমন একজন মানবসন্তানও এদেশে নেই।আরেকটা ঘটনা বলি।সালটা সম্ভবত ২০১৭; শুক্রবার ছিলো।জুমুআর নামাজ পড়তে ভার্সিটির সেন্ট্রাল মসজিদের দিকে যাচ্ছিলাম।এমন সময় একটা অপরিচিত বাস বাসস্টপে এসে থামলো।বাসের গায়ে লেখা দেখলাম- নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বাস থেকে নেমেই কয়েকজন আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন- আচ্ছা ভাই,বটগাছটা কোন দিকে? আমি বললাম- কোন বটগাছ? সে বললো- নজরুল যে বটগাছের নিচে বসে বাঁশি বাজাতেন সে বটগাছ।আমি আঙুল দিকে দেখিয়ে দিলাম- ঐ দিকে! তারপর সবিনয়ে জিজ্ঞেস করলাম - আপনারা কোথা থেকে এসেছেন,কেনই-বা এসেছেন? তারা আমাকে বললেন - আমরা নোবিপ্রবি থেকে এসেছি, মূলত নজরুলকে দেখতে এসেছি। আমি বললাম- এখানে তো নজরুলকে দেখার মত অনেককিছুই সংরক্ষিত নেই। তারা বললেন- একটা বটগাছ হলেও তো আছে।ধরে নেন- শুধুমাত্র একটা বটগাছ দেখার জন্যই নোয়াখালি থেকে এখানে এসেছি।কথাটা শুনে একটু মুচকি হাসলাম আর ভাবলাম- আমার জন্য এর চেয়ে গর্বের বিষয় আর কি-ই বা হতে পারে?
এবার আসি আমার অনার্স লাইফ জীবনে। ভার্সিটিতে এসেই নতুন নতুন বন্ধু পেয়েছি।নতুন নতুন জায়গার স্বাদ নিয়েছি।ক্যাম্পাসের এমন কোন জায়গা নেই,যেখানে আমার পদচারণা পড়ে নি। ফার্স্ট গেইট থেকে থার্ড গেইট,চক্রবাক থেকে অগ্নিবীণা, কলা ভবন থেকে সামাজিক বিজ্ঞান ভবন, বঙ্গবন্ধু হল থেকে সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, জয় বাংলা থেকে শেওড়া তলা, শব্দমঙ্গল থেকে চির উন্নত মম শির, ব্যথার দান থেকে দুখু মিয়া বাংলো! সিন্ধু সারসের ঘাটে বসে রাতেরবেলা বাঁশির সুর আর গাহি সাম্যের গান মুক্তমঞ্চে নাঁচ-গানের প্রোগ্রাম ; আমায় শুধু মুগ্ধই করে নি; অজানা সুর-লহরীতে হারিয়ে নিয়ে গেছে। চুরুলিয়া মঞ্চের কবিতা আবৃত্তি আর থিয়েটার রুমে বসে দেখা মঞ্চনাটক আমায় যে তৃপ্তি দিয়েছে; তা বলতে গেলে খাতা ফুরিয়ে কলমের কালিও হয়তো শেষ হয়ে যাবে। চক্রবাক ক্যাফেতে বসে লাল চা খাওয়া আর বকুলতলায় চারুকলার শিক্ষার্থীদের নয়নাভিরাম চিত্রাঙ্কন - আমায় এক অনন্য স্বাদে আচ্ছন্ন করেছে।সন্ধ্যা হলেই চিকনা মোড়ে পিয়াজু খেতে যাওয়া আর রাত ঘনিয়ে এলেই- অগ্নিবীণা হলে গান-বাজনা আর মুড়ি পার্টির আয়োজন- সব যেন জীবনকে রঙিন থেকে রঙিনতর করেছে। দোলন-চাঁপা আর অগ্নিবীণা হলের মাঝখানের পুকুর থেকে মাছ মেরে মাছের 'বারবিকিউ' তৈরি করা আর বিজ্ঞান ভবনের পিছনের আমগাছগুলো থেকে আম পেড়ে এনে ভর্তা করে বন্ধুবান্ধব নিয়ে খাওয়ার যে আনন্দ- তা কি আর অন্য কিছুতে পাওয়া যাবে? হলে পড়ার টেবিলে বসে সেন্ট্রাল ফিল্ডের ফুটবল খেলা দেখা আর বিবিএ ভবনের দিকে যাওয়া শাড়ি পড়া দৃপ্ত তরুণীর পায়ের আওয়াজ- কার না ভালো লাগে?